কাপাসিয়া প্রকৃতির সৌন্দর্যের সমারোহ্ - Sokalerkotha -->

Breaking News

কাপাসিয়া প্রকৃতির সৌন্দর্যের সমারোহ্


তৌফিক সুলতান (বিশেষ প্রতিবেদন) :
দুহাজার বছরের প্রাচীনতম জনপদ কাপাসিয়া চমৎকার এক প্রকৃতি সৌন্দর্য নিয়ে গড়ে উঠেছে এই প্রাচীন জনপদের সৌন্দর্য সমারোহ। কাপাসিয়া ঢাকার খুব কাছে হওয়ায় চাইলে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন। এই উন্মুক্ত অঞ্চলটিতে প্রবেশের জন্য আপনাকে কোনো অতিরিক্ত অর্থ ব্যায় করতে হবে না। নেই কোনো প্রবেশ মূল্য যেন এক প্রকৃতির রাজ্য কিংবা পার্ক। যেখানে প্রবেশের জন্য টিকেট সংগ্রহ করা প্রয়োজন কিন্তু কোনো দিবস উপলক্ষে সবার জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। যারা তাদের ক্লান্ত সময় কাটিয়ে উঠতে চান তারা তাদের মন ভালো করতে সতেজ নিঃশ্বাস নিতে। ঘুরে আসুন কাপাসিয়ার মনোমুগ্ধকর বিভিন্ন স্থানে আপনার ভালো লাগবে। একটা বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখবেন প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে গিয়ে। গজারি গড়ের গভীরে হারিয়ে গেলে পরতে পারেন নানা রকম অসুবিধায়। তাই এই বিষয়ে আপনাকে বিশেষ ভাবে সতর্ক থাকতে হবে। 
গাজীপুর জেলার অন্তর্গত কাপাসিয়ায় উপজেলার বারিষাব ইউনিয়নের নরাইট বিল। যেখানে ফুটে আছে শাপলা ফুল। সকাল, দুপুর, বিকাল সবসময় লাল শাপলার সমারোহ যেন এক প্রাকৃতিক স্বর্গ। সবুজের মাঝে লাল শাপলার বিচরণ দেখেই চোখ জুড়িয়ে যায়। সবাই এখন একে শাপলা বিল নামেই চেনে। সূর্যের স্বর্ণোজ্জ্বল রশ্মি পানিতে পড়তেই কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয় বিলের সৌন্দর্য। বছরের এই সময়ে যারা ঢাকার আশেপাশে থাকেন, ছুটে আসেন বিলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। ছোট্ট এই গ্রাম এখন ভ্রমণপিপাসুদের কেন্দ্রবিন্দু। জুলাই থেকে শাপলা ফোটা শুরু হয়। বিলের সঙ্গে যাদের বাড়ি, শাপলা তুলতে কিংবা মাছ ধরতে কলাগাছের তৈরি ভোরকা বা ভেলা, তাল গাছের তৈরি কুন্ধা এবং ছোট নৌকাই তাদের একমাত্র বাহন। এক পলকে মনে হবে, কোনো ক্যানভাসে আঁকা লাল শাপলার আহা কি চমৎকার চিত্র। সবুজ আর পানিতে ঝিলিকদেওয়া আকাশের মাঝে বিলজুড়ে শাপলার রাজত্ব।
এখানে ঢাকার আশপাশ থেকে প্রতিদিন অনেক মানুষ আসছেন পাশাপাশি বিদেশি অনেক পর্যটক আসছে প্রতিনিয়ত। শাপলা বিলে পরিচিতি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এর সুনাম ছড়িয়ে যাচ্ছে চারদিকে। পর্যটকরা মুগ্ধ পর্যটকদের ভিড় আর মুগ্ধতায় এলাকার মানুষও ভিষণ আনন্দিত।



শাপলা বিলের পাশে অবস্থিত বর্জ্জাপুর গ্রাম সেই গ্রামের মানুষ ফাহাদ, জোনায়েদ, সাদিকুল, মিজান, সাইফুল সাদেকা তারা সাই বলছে আমরা খুবই আনন্দিত এখানে ঘুরতে আসা পর্যটকদের আনন্দ দেখে। তাদের কে আনন্দিত দেখতে পেয়ে আমাদেরও আনন্দ হয় তবে এর যথাযথ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন প্রয়োজন। যার মাধ্যমে এলাকার বেকার যুবকদের কর্ম সংস্থানের ব্যাপক সুযোগ তৈরি হতে পারে।
তবে এই বিষয়ে এলাকার মানুষদের সহযোগিতার পাশাপাশি প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগ। শাপলা বিল ছাড়াও এখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সাজানো মনোমুগ্ধকর অনেক টেক বিল ও নিদর্শন রয়েছে। 
যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে শাপলা বিলের মতো ঐ সমস্ত স্থানও হয়ে উঠবে পর্যটকদের আকর্ষনের কেন্দ্র বিন্দু। শুধু প্রয়োজন উদ্যোগ গ্রহণ এবং এর যথাযথ বাস্তবায়ন। পুরো অঞ্চল প্রকৃতির সৌন্দর্যে সাজানো মনোমুগ্ধকর অপার স্নিগ্ধতার ভালো লাগার পরিবেশ।


যারা এখানে আসতে চান, তাদের ঢাকা থেকে আসতে হলে মহাখালী থেকে সম্রাট গাড়ী দিয়ে চালা বাজার এসে নামতে হবে। চালা বাজার থেকে অটোরিকশা অথবা সি এনজি রিজার্ভ করে সরাসরি শাপলা বিলে চলে আসতে পারেন। অথবা বর্জ্জাপুর বাজারে নেমে গাড়ি নিতে পারেন কিংবা পশ্চিম দিকের পথধরে হেটে চলে আসতে পারেন চারপাশের প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে পাশেই দেখা মিলবে পদ্মফুলের সাথে এরপরই আপনার কাঙ্ক্ষিত স্থান শাপলা রাজ্য। অন্য বাসে আসতে চাইলে দ্বিতীয় পথ টি হলো অন্যন্যা, উজানভাটি, জাল সিড়ি টিকেট কাউন্টার থেকে আমরাইদ বাজারের টিকেট কাটতে হবে। বাস আপনাকে এয়ারপোর্টে - টঙ্গী - গাজীপুর চৌরাস্তা - রাজেন্দ্র পুর - কাপাসিয়া - তরগাঁও হয়ে আমরাইদ বাজার নিয়ে আসবে। আমরাইদ বাজারে যাওয়ার পর আপনাকে বাস থেকে নামতে হবে এবার পূর্বদিকের রাস্তা ধরে গেলে গিয়াসপুর বাজার ভায়া জলিল মার্কেট পৌঁছে যাবেন। জলিল মার্কেটে গিয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে। এখন আপনি কোনো অটোরিকশা নিতে পারেন কিংবা উত্তর দিকের রাস্তা দিয়ে হেঁটে বা আপনার নিজস্ব যানবাহনে করে পৌঁছে যেতে পারেন শাপলা বিলে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা এসেছেন বিলের জলে ফুটন্ত লাল শাপলা দেখতে। আশা করা যায়, শিগগির এটি দেশের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হবে।


গাঢ় সবুজের বুকে ফুটে উঠা এ যেন বাংলার ‘লাল স্বর্গ’। বিলে লাল, সাদা ও বেগুনি রঙের শাপলা জন্মালেও লাল শাপলা বেশি লাল ও সাদা শাপলাকে শাপলা বলা হলেও বেগুনি শাপলা কে এলাকার মানুষ সন্দি বা সন্ধি বলে ডাকে। এই ফুল থেকে ফল হয় যাকে এলাকার মানুষ বেট বলে তা খাদ্য হিসেবেও গ্রহণ করা হয়। এই বেট তুলে আবার বিভিন্ন প্রসেসিং করে খই বা মুড়ির মতো ভেজে খাওয়া হয়। শাপলা গাছের নিচেও শাপলা ফল বা বিচি হয় যাকে শালুক নামে ডাকা হয়। এই শালুক উঠিয়ে পরিষ্কার করে রৌদ্রে শুঁকানো হয়। ভেজে এই শালুক খাওয়ার উপযোগী করা হয়। যদিও না ভেজেও খাওয়া যায় তবে ভেজে খেতে ভিষণ মজা। বিলের যত ভেতরে চোখ যায়; ততই লালের আধিক্য সবুজের মধ্যে এ যেন অটোম্যান সাম্রাজ্যের জেনেচেরি সৈনিকের দল। একপর্যায়ে মনে হবে শাপলার রাজ্যে হারিয়ে গেছেন। দেখা মিলবে, অনেক মানুষের কেউ কেউ মুঠো ভরে শাপলা তুলে নিয়ে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ ফটোসেশান করছে করছে শর্টভিডিও। শাপলার বিল শুধু সৌন্দর্যের জন্য নয়, জীবিকারও মাধ্যম। বিল থেকে শাপলা তুলে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে কিছু পরিবার জীবিকা নির্বাহ করছে। এলাকার কেউ কেউ বিলের শাপলার ওপর নির্ভরশীল। কেউ শাপলা তোলেন, কেউবা বিল থেকে মাছ শিকার করে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।


অনেকের পছন্দের তরকারি শাপলা। গ্রামের মতো শহরেও দিন দিন এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। সহজলভ্য শাপলা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। শাপলায় আছে প্রচুর ক্যালসিয়াম। শাপলায় ক্যালসিয়ামের পরিমাণ আলুর চেয়ে সাতগুণ বেশি। শাপলা চর্ম ও রক্ত আমাশয়ের জন্য বেশ উপকারী।
বিলে ভ্রমণের জন্য চাইলে স্থানীয়দের কাছ থেকে ছোট নৌকা ভাড়া করা যায়। বিলে ভেসে বেড়াতে বেড়াতে আত্মতৃপ্তি অনুভূত হবে। যেন এই তো শুধু আমার সোনার বাংলাদেশ নয়, সুখের ঠিকানা। এত কিছুর মাঝে আবার দেখা মিলবে অনেক পাখি। বক, মাছরাঙা, শালিক, চড়ুইসহ নাম না জানা পাখি এসে বিলের মাঝে কিচিরমিচির করে তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। যারা ঢাকার আশেপাশে থাকেন, তারা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে একদিনের জন্য ঘুরে আসতে পারেন। কম খরচে সহজে যাওয়ার জন্য উত্তম জায়গা এটি। এই বিলে নৌকায় চরে কাঁটাতে পারবেন সুন্দর মুহূর্ত। এই বিলের সৌন্দর্য আপনার ক্লান্তি কেরে নিয়ে উৎফুল্ল দিয়ে পূর্ণ করে দিবে ক্লান্তির আবরণ।
আশেপাশে আরও অনেক সুন্দর জায়গায় রয়েছে সময় থাকলে সে গুলোও ঘুরে দেখতে পারেন। প্রয়োজনে গুগলের সাহায্য নিতে পারেন ওয়েলফশন অফিস রোড ধরে সামনে গেলেই পেয়ে যাবেন অনেক সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর সব স্থান।
যেমন : ১০০ বছর যাবত কারোদের অধীনে থাকা কারোর টেক প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগের জন্য এক মন মুগ্ধকর স্থান।


প্রায় দুই যুগ পূর্বে প্রতিষ্ঠিত সৌদিয়া বড় মসজিদ,সেখানে ওয়েল্ফশন অফিস এর উত্তর পাশে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে থাকা দুই যুগ পূর্বে নির্মিত ইটের তৈরি মিনার। লোহাদির লোহার খনি- যদিও অল্প কিছু নিদর্শনই দেখতে পারবেন সময়ের সাথে সাথে প্রায়ই হারাতে বসেছে এসব।
ধাঁধা চর সহ ঘুরে আসতে পারেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহাম্মেদ এর বাড়ি মুগল আমলে সম্রাট আকবরের সময় প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আবুল ফজল তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আইন-ই-আকবরীতে’ উল্লেখ করেছেন যে, ‘‘ঢাকার অদূরে কাপাসিয়া অঞ্চলে বারিষাব ইউনিয়নের লোহাদী অঞ্চলে লোহা পাওয়া যেত। যার লোহা দিয়ে কামার গাঁওয়ের কামারগন অস্ত্র তৈরি করে বার ভূইয়াদের নেতা ঈসা খাঁকে সরবরাহ করত। মীর জুমলার আমলের কামানগুলো লোহাদী গ্রামের খনি থেকে উত্তোলিত লোহা দিয়ে তৈরী বলে জানা যায়। প্রখ্যাত ইংরেজ চিকিৎসক ও ঢাকার সিভিল সার্জন (১৮৬০) জেমস ওয়াইজের মতে, কাপাসিয়ার উত্তরাঞ্চল লৌহ সম্পদে সমৃদ্ধ। লোহাদী গ্রামের লোহার যে স্তরটি মাটির উপর বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে তা আকরিক লোহার উজ্জল নির্দশন। মাটির উপরে ও নীচে রয়েছে এক প্রকার আয়রন হুড। জাতীয় যাদুঘরের মহাপরিচালক ডঃ এনামুল হক ও জনৈক বিশিষ্ট প্রত্নতাত্ত্বিক ১৯৭৮ সালে কাপাসিয়ার উত্তরাঞ্চলে সফরে আসেন। তিনি অসংখ্য পুরাকীর্তি সমৃদ্ধ কপালেশ্বর নামক প্রাচীন গ্রাম পরিদর্শন করেন। তার মতে রাজা শিশুপালের রাজধানী ছিল এখানে এবং গ্রামের মধ্যখানে অবস্থিত শান বাঁধানো বিরাট অট্রালিকায় বাস করতেন। পার্শ্ববর্তী দরদরিয়াতে শিশুপালের দূর্গ ছিল, যাতে রানী ভবানী বাস করতেন। একই সময়ের তারাগঞ্জ এর একডালার দূর্গও ইতিহাস সমৃদ্ধ।দরদরিয়া গ্রামের ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দরদরিয়া দুর্গের ভূমির উপরিভাগের সব স্থাপনা বিলীন হয়ে গেছে। ইতিহাস–সম্পর্কিত বেশ কিছু বই ঘেঁটে ও স্থানীয় বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কাপাসিয়ার দুর্গাপুর ইউনিয়নের তারাগঞ্জ এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীরে ইতিহাস বিখ্যাত একডালা দুর্গ ছিল। দুর্গটি প্রস্থে ছিল ২ মাইলের বেশি ও দৈর্ঘ্যে ৫ মাইল।


নদীর পাশে নির্মাণ করা ওই দুর্গের ভেতরে প্রবেশের জন্য ছিল পাঁচটি তোরণ। দুর্গটি স্থানীয় মানুষজনের কাছে ‘রানিমার ভিটা’ ও ‘রানি ভবানীর বাড়ি’ নামেও পরিচিত ছিল। রানি ভবানী বানিয়া রাজাদের শেষ বংশধর ছিলেন। তিনি ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে এ দেশে মুসলিম অভিযানের সময় এ দুর্গে বসবাস করেছিলেন। তাছাড়া ঘুরে যেতে পারেন টোকের শাহী মসজিদ যার রয়েছে এক গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাস কাপাসিয়া সম্পূর্ণ অঞ্চলটাই হতে পারে পর্যটন শিল্প।

No comments