স্বর্ণের ডিমের জন্য হাঁসের পেট কাঁটা নাকি হাঁসের যত্ন নেয়া - Sokalerkotha -->

Breaking News

স্বর্ণের ডিমের জন্য হাঁসের পেট কাঁটা নাকি হাঁসের যত্ন নেয়া

শিল্প পুঁজিবাদ বনাম প্রাকৃতিক পুজিবাদঃ স্বর্ণের ডিমের জন্য হাঁসের পেট কাঁটা নাকি হাঁসের যত্ন নেয়া।


ইশপের গল্পের সেই লোভী কৃষক টার কথা মনে আছে? ঐ যে, যেই কৃষকের একটা হাঁস ছিল, যা স্বর্ণের ডিম দিত প্রতিদিন একটা করে। লোভী কৃষক যেখানে প্রতিদিন একটা ডিমের পরিবর্তে একসাথে সব ডিম পাবার লোভে শেষ পর্যন্ত তার হাঁস টা কেই মেরে ফেলল। তার আম ছালা দুইটাই গেল।


আবার মনে করি যে এই গল্পের কৃষক আবার এরকম একটা হাঁস পেল। ন্যাড়া তো একবার ই বেল তলায় যায়। সুতরাং গতবারের মত ভুল এবার আর সে করল না, বরং হাঁসটার অনেক যত্ন করল এবং সে তো বটেই তার ১৪ পুরুষ এই হাঁসের ডিমের সুফল ভোগ করল।
এখন মনে করা যাক, হাঁস টা হল প্রকৃতি বা nature , আর ডিম যদি পণ্য হয়, তাহলে হাঁসের পেট কেটে ডিম বের করতে চাওয়াটা হল শিল্প পুঁজিবাদ, যেখানে প্রকৃতির যাই  হোক না কেন, তার কোন মাথা ব্যাথা নেই, যদিও আলটিমেটলি এটার ফল ভাল হল না অর্থাৎ আমার ডিম ও গেল আবার হাঁস ও গেল। 


আবার অপরদিকে কৃষকের ২য় বারের যে উদাহরণ যেখানে হাঁস রূপী প্রকৃতি কে সুষ্ঠু ব্যবহার এর মাধ্যমে প্রকৃতি কেই পুঁজি হিসেবে মনে করে তাকে বারবার ব্যবহার উপযোগী করে একটা দীর্ঘ ও স্থায়ী সময়ের জন্য সে লাভ করল এবং সেটা করতেই থাকল। প্রাকৃতিক পুঁজিবাদ অনেকটা এই ধরণের কনসেপ্ট হিসেবে আমাদের বর্তমান অর্থনীতি তে তার বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। 


দুঃখের বিষয় হল এই যে বর্তমান সময়ের যে পুঁজিবাদের চর্চা হচ্ছে এই পৃথিবী জুড়ে, অর্থাৎ শিল্প পুঁজিবাদ সেটি খুব বেশী প্রকৃতি বিরুদ্ধ। সমস্যা হত না যদি এটা প্রাকৃতিক পুঁজিবাদের যেই সকল উপাদান তাকে মূল্য না দিত, কিন্তু এখানে মুল্য না দেওয়ার সাথে সাথে যেই জিনিসটা হচ্ছে তা হল প্রাকৃতিক উপাদান গুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বলতে গেলে এই শিল্প পুঁজিবাদ ধ্বংস করে দিচ্ছে এই প্রাকৃতিক পুঁজিবাদকে। 
এখন আমরা প্রাকৃতিক পুঁজিবাদ বলতে মূলত কী বুঝি?? এটি অনেকটা আমার লেখার শুরুর ঐ হাঁসের গল্পের মতই। অর্থাৎ প্রাকৃতিক পুঁজিবাদ বলতে বুঝায় এমন এক অর্থনৈতিক অবস্থা যেখানে লাভ হবে প্রকৃতিকে যত্ন করে বা যত্নের সাথে ব্যবহার করে, একে ধ্বংস করে না। প্রাকৃতিক পুঁজিবাদের মতে যে সকল পুঁজি আছে প্রকৃতিতে তাদের অর্থনৈতিক মুল্য ছাড়া আরও মুল্য আছে যেই মুল্য হল এমন মুল্য যার আসলে মুল্য নির্ধারণ করা সম্ভবপর হয় না, অর্থাৎ তা হল অমুল্য।


প্রাকৃতিক পুঁজিবাদে মূলত ৪ টি উপাদান পরস্পরের সাথে সম্পর্ক যুক্ত। এরা হল প্রকৃতি, মানুষ, পণ্য এবং সবশেষে আসে টাকা। মূলত এই পুঁজিবাদ ধারণায় পুঁজি হিসেবে আসে প্রকৃতি। ইকো সিস্টেম, বা আশে পাশের নেচার কেই বলা হচ্ছে এখানে পুঁজি। এরপর উৎপাদক বা producer হিসেবে মানুষ, যে এই পুঁজি কে ব্যবহার করবে এবং এরপর উৎপাদিত পণ্য বা commodity এবং সবশেষে এই পণ্য বাজার জাত করে প্রাপ্ত হল টাকা। এই টাকা কে দিয়ে আবার যত্ন করতে হবে তার সেই প্রকৃতিকে। এভাবেই মূলত প্রাকৃতিক পুঁজিবাদ একটি স্থায়ী উন্নয়ন সৃষ্টি করতে থাকে।
খুব সাধারণ ভাবে যদি চিন্তা করা হয় যে এই প্রাকৃতিক পুঁজিবাদ কিভাবে আমাদের অর্থ সাশ্রয় করে থাকে? ছোট একটা উদাহরণের মাধ্যমে আমরা এই বিষয়টা সম্পর্কে ধারণা পেতে পারি।


এখানে পুঁজি হিসেবে ধরা যাক ইকো সিস্টেম বা বাস্তু সংস্থানের বিষয় টা। প্রকৃতিতে বাস্তুসংস্থান খাদ্যচক্র নিয়ন্ত্রণ করে, জলবায়ুর ভারসম্য বজায় রাখে, পরাগায়ন ঘটায়, জীব বৈচিত্রের সৃষ্টি করে, কীট পতঙ্গ  ও  ভাইরাস কে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে এবং সবচাইতে জরুরি ব্যপার টা হল তা পরিবেশের যে বর্জ্য গুলো আছে তাকে শোষণ করে এবং যা প্রকৃতিতে থাকে তা বিষ মুক্ত করে।  এক এই ইকো সিস্টেম ই যে সেবা প্রদান করে তার আর্থিক মুল্য হয় এক বছরে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের ও অনেক বেশী। যা কিনা পুরো বৈশ্বিক অর্থনীতির চাইতেও বেশী। সত্য কথা বলতে এর মুল্য অনেকটা হবে অসীম এর কাছাকাছি, কারণ এটি ছাড়া পৃথিবীর কোন প্রাণ এর ই ঠিক মত বাচার কথা না, অর্থনৈতিক কোন কারবারের তো প্রশ্নই আসে না। 


আবার কিছু কিছু উপাদান চিন্তা করেন। ২০০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে আপনি মাত্র ৮ জন ব্যক্তির শ্বাস নেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারবেন, যেখানে প্রকৃতি ৬ ট্রিলিয়ন মানুষের টা করছে প্রতিদিন, তা আবার বিনামুল্যে। তারমানে প্রকৃতির অনেক কিছুই আসলে অমুল্য। এটি যখন ধ্বংস হয় তখন তা অনেক বড় অর্থনৈতিক ক্ষতি হিসেবে দেখা দেয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাধ্যমে।


এই প্রাকৃতিক পুঁজিবাদ মূলত ৪ টি মূলনীতির উপর চলে। প্রথমটি হলঃ
১) ক্রমান্বয়ে সম্পূর্ণ ভাবে প্রাকৃতিক সম্পদের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধিঃ
প্রযুক্তি ও উৎপাদন ডিজাইনের কিছু মৌলিক পরিবর্তনের মাধ্যমে কিছু দূরদর্শী কোম্পানি যেটা করছে সেটা হল প্রাকৃতিক সম্পদের যেমন পানি, খনিজ বা শক্তির সেবা ক্ষমতা ৫,১০ এমনকি ১০০ গুন বেশী করা যা বর্তমানে আছে তার চাইতে।
এটি পরের ৩ টি মুলনীতিকে সহজ করে তুলবে তুলনামুলক ভাবে। 


২) জৈবিক উৎপাদন মডেলে শিফট করাঃ
প্রাকৃতিক পুঁজিবাদ কখনও জৈবিক যে সকল বর্জ্য আছে তাকে সম্পূর্ণ রূপে শেষ না করে চায় তা আবার বিভিন্ন ভাবে প্রকৃতিতে ফিরিয়ে আনতে। যেমন কমপোস্ট সার। এমনভাবে ফিরিয়ে আনতে চায় যাতে প্রকৃতির কোন ক্ষতি না হয়। 


৩) ক্রমাগত সেবা প্রদানকারী ব্যবসা মডেলঃ
বর্তমানের ব্যবসা মডেল বলতে মূলত বুঝাচ্ছে যে পণ্যের বিক্রয় টা। কিন্তু এই প্রাকৃতিক পুঁজিবাদের নতুন মডেল এই কথা বলে না। এটি বলছে ক্রমাগত সেবা জাকে ইংরেজীতে বলছে service and flow  এই সিস্টেমে। এখানে বারবার বাল্ব বিক্রির চাইতে এর দীপন ক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলে হয়েছে, যা পরিবেশের জন্য সাশ্রয়ী আবার ভোক্তাদের জন্য সুবিধাজনক।


৪) প্রাকৃতিক পুঁজিবাদে পুনরায় বিনিয়োগ করাঃ
কথায় বলে যে “টাকায় টাকা আনে”। ঠিক সেরকম ই প্রাকৃতিক পুঁজিবাদের মতে যত বেশী প্রকৃতির পুঁজির জন্য বিনিয়োগ করা হবে, সেটি তত বেশী সুফল বয়ে আনবে ।
এই ছিল মূলত প্রাকৃতিক পুঁজিবাদের উপর আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান দ্বারা করা আলোকপাত।
প্রাকৃতিক পুঁজিবাদের উপর সর্বপ্রথম আলোকপাত করা হয় ১৯৯৯ সালে, “Natural Capitalism: Creating the Next Industrial Revolution”  নামের বইটিতে, যেটির লেখক ছিলেন মূলত ৩ জন; পল হকেন, এমরি বি লভিন্স এবং আল হান্টার লভিন্স। 


লেখকঃ মাহ্‌দী যুবায়ের
- প্রভাষক- ইউনাইটেড পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, জামালপুর। 

No comments