হলে ম্যানেজারশিপ এবং কয়েকটি রাত নির্ঘুম কাটানোর গল্প


 

লিখেছেন: আবু হুরায়রা আতিক;

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল গুলোতে সাধারণত একটি মেস থাকে যেখানে ছাত্রদের দ্বারা মেনেজারি করানো হয়ে থাকে।  বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর কিছুদিন ক্যান্টিনের খাবার আমার কাছে  এত ভালো লাগলো যা অসাধারণ।  কিন্তু না ৪ টা মাস পর বুঝতে পারলাম এগুলো স্বাস্থ্য সম্মত খাবার না। হলের ভিতর দিয়ে যাতায়াত করার সময় মেইন বিল্ডিং এর মাঝখানে লুমিন্যাস নামে সুন্দর একটা ডিজিটাল বোর্ড দেখতে পেতাম। হঠাৎ একদিন  একজন সিনিয়র ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম ভাই এটা কী? ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময়ে ইংরেজি বইয়ে উইলিয়াম সমারসেটের লাঞ্চন নামক গল্পে প্রথম লুমিন্যাস শব্দটি পড়েছিলাম সেই কৌতূহল থেকেই জানতে চাওয়া। জনৈক ভাই বললেন এটা হলের মেস। নাম লুমিন্যাস, এখানের খাবার অনেক সুস্বাদু এবং স্বাস্থ্য সম্মত। ভাইকে পাল্টা প্রশ্ন করছিলাম যে ভাই আমরা খেতে পারবো না? জবাবে ভাই বলছিলেন যে তুমি  কোন ইয়ার? আমি বলছিলাম ফার্স্ট ইয়ার। তখন বলছিলেন এখানে মেম্বারশীপ নেওয়া বেশ জটিল প্রক্রিয়া।  তবে এতটুকু বলছিলেন যে প্রথম বর্ষের কেউ খেতে পারেনা। মানে আগ্রহ আরও বেড়ে গেলো। কি এমন বিষয় আছে এখানে যে এত ফর্মালিটিস! সত্যি সত্যি দ্বিতীয় বর্ষের শেষ দিকে হল কার্ড সমপন্ন হওয়ার পরে আবেদন করলাম। এসএসসি এইচএসসির ফলাফল ভালো ছিল বিধায় প্রথম লিস্টেই আমার নাম আসলো। 

ভাইভা দিলাম। মেম্বারশিপও পেলাম। খাইতে গিয়ে দেখলাম!  ওমা আজরাইলের মতো নানা ফর্মালিটি মেইনটেইন করতে হয়। এরপর আসলো ভোট দেওয়ার পালা! টাকা জমা দিয়ে খাবার খাইলাম সেশনে! মাগার ভোট দিতে দেওয়া হলো না আমাদের সেশনকে। মহাবিপদ!  ২০১৯ সালে এসেও আইয়ুব খানের মৌলিক গনতন্ত্রের চর্চার এক উৎকৃষ্ট আদর্শ দেখতে পেলাম! পরে বুঝতে পারলাম যে ভোট না দিতে দেওয়ার আসল কারণ কি! আসল কারণটা হচ্ছে,  লুমিনাসে খুব স্বল্প মুল্যে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। এটা করতে গিয়ে মেনেজারদেরকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। কিন্তু প্রথম যারা খাবার খায় তারা মনে করেন এমন কি খাবার খাওয়াইলেন যে আউট অব ৯ এ ৯ ভোট দিবো! 


মজার ব্যাপার হলো, এত কড়াকড়ি নিয়ম শৃঙৃখলা থাকা সত্বেও এখানে অন্তত, ২ বছর আগে মেনেজার হওয়ার জন্য আবেদন করতে হয়। আমি ম্যানেজারিটা করার জন্য বেশ কয়েকবার নাম লিখেছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পরীক্ষা থাকার কারণে বার বার পিছিয়ে নিয়েছি।জহুরুল হক হলের লুমিম্যাসের ইতিহাসে, ফাহিম, তরুন,আসাদুল্লাহ এক জীবন্ত কিংবদন্তির নাম! কেননা তারাই একমাত্র ৯/৯ ভোট প্রাপ্ত ম্যানেজার। আমারও টার্গেট ছিল ফাহিম- তরুন-আসাদুল্লাহদের  সেশনের মতো বিভিন্ন  ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়ে কাজ করবো। কিন্তু দুর্ভাগ্য যেন আমাদের পিছু নিয়ে চলল।  যখন মেনেজারি নিলাম তখন মোট সদস্য পেলাম মাত্র  ২৫৮ জন।তবুও ঈদের মাত্র ৫ দিন আগে। ৩ দিন যেতে না যেতেই মিল অন দাড়ালো মাত্রে ৭৯ তে। অবশিষ্ট সদস্য  সবাই মিল অফ করে বাসায় চলে গেল। মাত্র ৭৯,৮৩,১০২ এর মতো সংখ্যা নিয়ে মেনেজারি করতে  করতে থাকলাম।  আমরা তিন মেনেজার, অর্থাৎ আমি, আলমগীর,শান্ত অত্যন্ত  হতাশ হলাম! আমরা প্রত্যাশা করলাম কি আর ঘটলো কি! 


এদিকে আমার মিডটার্মের তারিখ পড়ে গেল। মেনেজারি করতে হলে একজন মেনেজারকে অন্তত ৪ দিন কারওয়ান বাজার, ৪ দিন পলাশি বাজার এবং ৫ দিন লুমিনাসের ভিতরে সারাক্ষণ তদারকি এবং শেষদিন তথা ফিস্টের দিন ( স্পেশাল আয়োজন, প্রায় ৪০০০০+ টাকার খরচ)  সারাদিন কাজ করতে হয়। এত ব্যস্ত শিডিউলের মধ্যে আমি একইসাথে পরীক্ষা এবং মেনেজারি করতে থাকলাম। এমনকি ঈদে বাসায় যাওয়া বাদ দিলাম।  যাতে কিছুটা পড়া এগিয়ে রাখা যায়।  কিন্তু সেটিও ভালো মতো হয়নি। কেননা ঈদে সকল ধরনের ক্যান্টিন, দোকান,মেস অর্থাৎ খাবারের দোকান বন্ধ থাকে। রান্না বানা করে খেতে গেলে দেখা যায় দিনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ চলে যায়।  যাইহোক কিছুটা পড়া এগিয়ে রাখছিলাম। ফিস্টের দিন তথা ২৪ তারিখে আমার পরীক্ষা ছিল।  এই দিনের পড়া আগে পড়ে রাখা হয়নি। ভাবছিলাম আগের দিন পড়ে নিবো। কিন্তু তা হলো না। ফিস্টের আগের রাতে রাত ৪ টা পর্যন্ত হিসাব শেষ করে ঘুমাতে আসলাম। ভাবলাম অন্তত সকালে ১ ঘন্টা হলেও পড়ব! কিন্তু না! ঘুম থেকে চোখ খুলে দেখি ৮.৫০ বাজে। কোম রকম একটু চোখে পানি দিয়ে দৌড় দিলাম লুমিনাসে। এরপর দুপুর২.৫০ পর্যন্ত বাজার চলল। বাজার শেষ হলে আমি দৌড়ে চলে আসলাম রুমে। কলম পেনসিল স্কেল নিয়ে দৌড় দিলাম পরীক্ষা দিতে।  আলহামদুলিল্লাহ,  পরীক্ষার হলে গিয়ে সকল ঐতিহাসিক / ইতিহাসবিদদের ভুলে গেলাম এবং আমি নিজেকেই  এ যুগের শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক মনে করতে লাগলাম। মনের সাথে মাধুর্য মিশিয়ে, সাহিত্যের সঙ্গে ইতিহাসের ব্যবধান না করে এক বিশ্বইতিহাস রচনা করলাম। শুধু একটা জায়গায় ভয় করতে লাগলাম, যদি আমার এই ঐতিহাসিক প্রবন্ধটি পরবর্তী অনুজদের জন্য প্রকাশনা আকারে বের হয় তাহলে সকল প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসবিদগণ নির্ঘাত সুইসাইট করবে। কিছু বড় ভাই,ছোট ভাই, বোন, শুভাকাঙ্ক্ষী আমার খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য নক দিয়েছেন।  কল, মেসেঞ্জারে নক দিয়েছেন। আমি হয়তো মেসেজ সীন করেছি কিন্তু রিপ্লাই করার সময় পাইনি। বিষয়টি নিয়ে মনে কষ্ট নিবেন না। আপনাকে গুরুত্ব দেয়নি বিষয়টি কিন্তু সেরকম নয়। আসলে আমাদের হলের সকল মানুষই যদি শোনে যে তিনি বর্তমান সেশনের মেনেজার তাহলে তার প্রতি ধারণা করা হয় যে তিনি অনেক ব্যস্ত। এটিই আসল কথা। কিন্তু বাহিরের মানুষজন এমনকি ক্যাম্পাসের অন্যান্য হলের মানুষেরাও অনেকে জানেনা যে লুমিনাসের মেনেজারিটা কি পরিমান চাপের। কয়েক লক্ষ টাকার হিসাব এবং সুক্ষ ব্যবস্থনার এক জটিল নাম হচ্ছে লুমিনাস। 


যাইহোক, সকল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সকল মানুষকে মন ভরে খাওয়ানো সম্ভব নয় এ সত্যটা মর্মে মর্মে অনুধাবন করলাম। দেখলাম নিজের কলিজা টা ভুনা করে খেতে দিলেও কিছু পাবলিক বলবে এত ঝাল দিয়েছে কে! লবন বেশি হয়েছে  কেন! তবে কিছু বড় ভাইয়েরা ছিলেন যারা মানসিকভাবে অনেক বড় সাপোর্ট দিয়েছেন।  সবসময়ই বলছেন খাবার সুন্দর হয়েছে।  তোমাদের আয়োজন বেশ সাজানো গোছানো।  এই সব আয়োজন করতে গিয়ে আমাদের প্রত্যককেই অন্তত ৫ রাত জেগে থাকতে হয়েছে।  এর মধ্যে ক্লাস,পরীক্ষ, এসাইনমেন্ট করতে হয়েছে।  এত ব্যস্ত শিডিউল থাকার কারণে অনেক মানুষের ফোন ধরতে পারিনি। এমনকি নিজের বাড়িতে কল করার সময়ও হয়ে ওঠেনি। ফলে কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী হয়তো আমার / আমাদের উপর রাগ করেছেন। তাদেরকে বলব,  আপনাকে আমাদের জায়গায় বসাবেন আশা করি রাগ কমে যাবে।  


ভোট: 

লুমিনাসে কোন সেশন কেমন খাওয়ালো এর উপর একটা রেটিং জরিপ করা হয়। যদি কোন সেশন ৮.৭৫ এর উপরে ভোট পায় তাহলে পরবর্তী দুই সেশন (১৫×২=৩০ দিন) সম্মানসূচক ফ্রি খাবার খাওয়ানো হয়। এর নিচে হলে মাত্র ১৫ দিন ফ্রি খাওয়ানো হয়। কথায় বলে অভাগা যেদিকে যায়, সেদিকের জল শুকিয়ে যায়! সাধারণত নতুন মেম্বারদের ভোট ৩ মাসের আগে নেওয়া হয় না। কেননা, নতুনেরা আসলে জানেন না যে কি পরিমাণ চাপ সৃষ্টি হয় মেনেজারি করতে৷  গত সেশনে নতুন মেম্বারদের ৩ মাস শেষ হয়ে গেছে।  মানে আমাদের সেশন থেকে নতুন মেম্বাররাও ভোট দিতে পেরেছেন। 


ফলাফল : আমরা আউট অভ ৯ এ  ৮.৭৫  ভোট পেয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ! এতো কম মেম্বার নিয়ে যে এত ভালো ভোট পেয়েছি তা আসলে ভালো খাওয়ায়ে না। এই ভোটটা দিয়েছেন আমাদের ফেইস ভ্যালু দেখে। কেননা, আমি, আলমগীর ছিলাম বাঁধনের সাধারণ সম্পাদক এবং সহসভাপতি আর শান্তও অনেক শান্ত ও নিরীহ প্রকৃতির অত্যন্ত ভদ্র ছেলে। কাজেই আমাদের প্রতি সকলের এক ধরনের ভালোবাসা থেকেই ভোট দিয়েছেন।  


ল্যাব( লুমিনাস এক্সিকিউটিভ বোর্ড)  এর প্রতি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। তারা আমাদের অনেক সাহস, বুদ্ধি এমনকি টাকা ধার দিয়েও সহযোগিতা করেছেন।  শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আমার লুমিনাসের সেইসকল বয়দের প্রতি যারা মাত্র শ খানেক টাকা আর অগাধ ভালোবাসার জন্য সারাদিন পরিশ্রম করে।  এদের প্রতি আমি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা।  সেই সাথে লুমিনাসের বাবুর্চি সুমন ভাই এবং নেসার ভাইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা।  যারা আমাদের সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করেছেন। 


সবাইকে অশেষ ধন্যবাদ পোস্টটি পড়ার জন্য।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url