-->

Breaking News

ব্রাহ্মণপাড়ার দিন বদলের রূপকার ইউএনও সোহেল রানা- নিজস্ব ওয়েবসাইট ও অ্যাপের মাধ্যমে শতভাগ টিকাদান

ব্রাহ্মণপাড়ায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহেল রানার “শতভাগ কোভিড টিকা” প্রোগ্রাম বাস্তবায়নে নিয়োজিত স্বেচ্ছোসেবক কর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রদান, বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিবন্ধন ও টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়ন।


তাপস চন্দ্র সরকার, কুমিল্লা প্রতিনিধি: টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে বরাবরই বাংলাদেশের সুনাম বিশ্বব্যাপী। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) পূর্বে নানা রোগের টিকাদান কর্মসুচি অন্যন্ত সফলতার সাথে পরিচালিত করে আসছে। ফলে দেশের স্বাস্থ্য বিভাগকে কোনো বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়নি কখনো। কিন্তু বিশ্বব্যাপী করোনার ভয়াল থাবা যখন বাংলাদেশেও বিস্তার লাভ করল, তখন নতুন এক ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে দেশ। অন্যান্য সময় ইপিআই সরাসরি টিকাকেন্দ্রের মাধ্যমে টিকা দিতে সক্ষম হলেও কোভিড টিকা প্রদানের সময় দেখা দেয় নতুন সমস্যা। একদিকে টিকা নিয়ে নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম-গঞ্জে। অন্যদিকে টিকার অপ্রতুলতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে  রেজিস্ট্রেশন থেকে শুরু করা টিকা কার্ডের প্রচলন গ্রামীণ সাধারণ মানুষের জন্য জন্য টিকা পাওয়ার পথকে কঠিন করে তোলে। ফলে প্রান্তিক, বয়স্ক, নিম্নবিত্ত এসব শ্রেণির মানুষকে টিকাদানে সম্পৃক্ত করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল স্বাস্থ্য বিভাগকে।  

এমন পরিস্থিতিতে ২০২১ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে কোভিডের তৃতীয় ওয়েভ শুরু হলে টিকা প্রদানের উপর জোর দেয় সরকার। সকলকে বাধ্যতামূলক টিকার আওতায় আনার কার্যক্রম শুরু করা হলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে এটি বাস্তবায়ন ছিল অত্যন্ত কঠিন। প্রত্যন্ত অঞ্চলে টিকা কার্যক্রম সফলভাবে বাস্তবায়নে একটি ভিন্নধর্মী উদ্যোগ গ্রহণ করে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা প্রশাসন। এই উদ্যোগের নাম “শতভাগ কোভিড টিকা” প্রোগ্রাম। যার নেতৃত্ব দেন ব্রাহ্মণপাড়ার উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সোহেল রানা। ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলাকে শতভাগ কোভিড টিকার আওতায় আনার লক্ষে উপজেলা প্রশাসন প্রোগ্রাম হাতে নেয়। উপজেলা প্রশাসনের অভিনব উদ্যোগসমূহের মধ্যে ছিল-  

১) উপজেলার বাসিন্দাদের মধ্যে যারা টিকা পাননি তাদের সনাক্তকরণের লক্ষ্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে পৌঁছে নিবন্ধন করানো। আর এ কাজে ২০২২ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি ২১৮ জন স্বেচ্ছাসেবককে ৮ ইউনিয়নে নিযুক্ত করে উপজেলা প্রশাসন। গুগল ফরম এর মাধ্যমে আবেদন সংগ্রহ করে সেচ্ছাসেবকদের তালিকা চূড়ান্ত করে তাদের সাথে বৈঠক করেন ইউএনও সোহেল রানা। প্রায় ২ সপ্তাহ ধরে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা প্রশাসনের উদ্ভাবিত প্রশাসনের উদ্ভাবিত মোবাইল অ্যাপ vaccine এর সাহায্যে এ নিবন্ধন কার্যক্রম চালায় স্বেচ্ছাসেবকরা। পরবর্তীতে ১৫ ফেব্রুয়ারি একযোগে ৮ ইউনিয়নের ৩২ উপকেন্দ্রে টিকা প্রদান ও একই সাথে মোবাইল অ্যাপের সাহায্যে আপডেট কার্যক্রম চালানো হয়। এই নিবন্ধন ও টিকাদান কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য www.covidvaccination-brahmanpara.gov.bd নামে একটি ওয়েবসাইটও চালু করা হয় যেখান থেকে টিকা কার্ড ডাউনলোড করার ব্যবস্থা রাখা হয়।

২) উপজেলা পর্যায়ে নিজস্ব ওয়েবসাইট ও উদ্ভাবিত মোবাইল অ্যাপের সাহায্যে টিকাদান কার্যক্রম গ্রহণ একটি মাইলফলক যা আর কোনো উপজেলায় বাস্তবায়ন হওয়ার খবর জানা যায়নি। সরকার কর্তৃক প্রণীত সুরক্ষা অ্যাপে নিবন্ধন করা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য কষ্টসাধ্য হওয়ায় সুরক্ষা অ্যাপের সাহায্যে এই কার্যক্রম উপজেলায় সম্পন্ন করা কঠিন। সে কারণে উপজেলা প্রশাসন ব্যতিক্রমধর্মী এবং কষ্টসাধ্য এ পদক্ষেপ হাতে নেন। উপজেলা প্রশাসনের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নিবন্ধনের পর প্রত্যেক নাগরিকের মোবাইল নম্বরে টিকা প্রদানের দিন-তারিখ আসে। এছাড়াও গ্রাম পুলিশের কাছে ওয়ার্ডভিত্তিক টিকা যারা পাবেন তাদের তালিকা প্রদান করা হয়। সেই তালিকায় যারা অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন তারা উপকেন্দ্রে গিয়ে টিকা নেন। উপকেন্দ্রে টিকা নেওয়ার সময় অ্যাপের সাহায্যে টিকা তথ্য এন্ট্রি করা হয়। সেই তথ্য নিজস্ব ওয়েব সার্ভারে জমা হবে এবং নাগরিকগণ এই ওয়েবসাইট থেকে টিকা কার্ড ডাউনলোড করেন। 

৩) এই প্রোগ্রামে নতুন মাত্রা যোগ করে ওয়ান স্টপ সার্ভিস। টিকাদান কর্মসুচির পরিধি বাড়ানোর জন্য ইউএনও সোহেল রানার সরাসরি তত্ত¡াবধানে সুবিশাল স্বেচ্ছাসেবক দলের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে একই সাথে নিবন্ধন ও টিকা প্রদান কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। কোভিড টিক প্রধানের ক্ষেত্রে এ ধরণের উদ্যোগ অভিনব। প্রোগ্রামের এই দিকটিও একটি মাইলফলক হয়ে রয়েছে। 

৪) স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য প্রস্তুত করা হয় বিশেষ নির্দেশিকা। যেমন- কোন বয়সের মানুষ টিকা নিতে পারবেন, স্কুল/কলেজের শিক্ষার্থী বিদেশ গমনেচ্ছুকেদের ক্ষেত্রে কী করণীয় হবে, কারা উপজেলা প্রশাসনের বিশেষ কেন্দ্রে (৩২ উপকেন্দ্রে) টিকা পাওয়ার যোগ্য হবেন, কারা হবেন না সেসব বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে উপজেলা প্রশাসন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। বিশেষ করে জটিল রোগে আক্রান্তরা গর্ভবতী বা দুগ্ধ প্রদানকারী মা, জন্ডিস, মৃগীরোগ, অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ অথবা ডায়াবেটিস থাকলে কিংবা টিকায় এলার্জি থাকলে টিকা প্রদানের দিন জ্বর-সর্দি-কাশি থাকলে বা কোভিড-১৯ পজিটিভ থাকলে রক্তক্ষরণ বা রক্ত জমাটবাধা জনিত রোগ থাকলে তাদের আলাদাভাবে বাছাই করে ডাক্তারের কাছে পরামর্শ নেওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করেন স্বেচ্ছাসেবকরা। ফলে উপকেন্দ্রে টিকা গ্রহণকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত হয়।   

৫) শতভাগ কোভিড টিকা প্রোগ্রামটি নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, মেম্বার ও গ্রাম পুলিশ সমন্বয়ে সভার আয়জন করা হয়। গ্রামে গ্রামে লিফলেট বিতরণ ও মাইকিং করা হয়। এর ফলে দ্রæত প্রান্তিক জনসাধারণকে টিকাদান কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করা সম্ভব হয়। আর এ কাজের জন্য বিশেষভাবে কৃতিত্ব পাওয়ার যোগ্য উপজেলা প্রশাসন তথা ইউএনও সোহেল রানা।  

শতভাগ কোভিড টিকার মাঠ পর্যায়ে উপজেলা প্রশাসনের সাথে কাজ করেছেন দুলালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান রিপন ভূঁইয়া। তিনি বলেন, “উপজেলার প্রান্তিক জনসাধারণের জন্য উপজেলা প্রশাসনের “শতভাগ কোভিড টিকা” কর্মসূচি একটি অসসাধারণ উদ্যোগ ছিল। এর মাধ্যমে গ্রামীণ জনসাধারণ অতি সহজে টিকার আওতায় আসতে সক্ষম হন। নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজ হওয়ায় সাধারণ জনগণ স্বতস্ফুর্তভাবে টিকাকেন্দ্রে এসে টিকা গ্রহণ করেন। ইউএনও সোহেল রানার এমন উদ্যোগের কারণে ব্রাহ্মণপাড়াবাসী শতভাগ টিকা নিয়ে অতিমারি করোনা থেকে সহজেই মুক্তি লাভ করতে সক্ষম হন।

স্বেচ্ছাসেবক টিমের টিমলিডার এইচএম সাকিব অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, “ব্রাহ্মণপাড়া একটি সুবিধাবঞ্চিত ও প্রত্যন্ত উপজেলা। আমরা প্রতিটি ইউনয়নে ৪০জন করে প্রায় ৩০০জনের একটি সুবিশাল টিম উপজেলা প্রশাসনের শতভাগ কোভিড টিকা প্রোগ্রামে কাজ করি। যখন জানতে পারলাম উপজেলা নির্বাহী অফিসার সোহেল রানা স্যার পুরো উপজেলাকে ভ্যাকসিনেশনের আওতায় আনতে মোবাইল অ্যাপ ও নিজস্ব ওয়েবসাইট তৈরি করেছেন তখনই এই প্রোগ্রামের সাথে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করি। আমার মতো তরুন সমাজের অনেকেই উপজেলা প্রশাসনের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানান এবং দিনরাত পরিশ্রম করে উপজেলাকে শতভাগ ভ্যাকসিনেশনের আওতায় আনতে সক্ষম হই। দেশের ক্রান্তিকালে এমন ইতিহাসের সাক্ষী হতে পেরে আমি গর্বিত। এজন্য ব্রাহ্মণপাড়ার উপজেলা নির্বাহী অফিসার সোহেল রানা স্যারকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই”।

ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আবু হাসনাত মোঃ মহিউদ্দিন মুবিন বলেন, “ব্রাহ্মণপাড়ার মতো একটি অনগ্রসর উপজেলাকে শতভাগ কোভিড টিকার আওতায় আনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। আমাদের হাতে একদিকে যেমন ছিল কর্মি সংকট অপরদিকে আমাদের হাতে ডাটাবেইজ না থাকায় কারা টিকার আওতায় এসেছে আর কারা আসেনি এ বিষয়ে আমরা এক প্রকার অন্ধকারে ছিলাম। উপজেলা প্রশাসনের শতভাগ কোভিড টিকা প্রোগ্রামের কারণে আমরা টিকা গ্রহিতা ও বাদ পড়াদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য জানতে পারি। সেই আলোকে সবাইকে কোভিড টিকার আওতায় আনতে সক্ষম হই। উপজেলা প্রশাসন আমাদের একটি সুবিশাল স্বেচ্ছাসেবক টিম দেয় এবং ৩২টি বিশেষ টিকা কেন্দ্রের ব্যবস্থা করেন। সেখানে স্বেচ্ছাসেবকদের সাহায্যের আমাদের কর্মিরা কাজ করে উপজেলাকে শতভাগ কোভিড টিকার আওতায় আনা সম্ভব হয়। জনসংখ্যায় ছোট হওয়া সত্তেও টিকা গ্রহণে জেলায় দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ব্রাহ্মণপাড়া। এজন্য বিশেষভাবে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য ব্রাহ্মণপাড়ার উপজেলা নির্বাহী অফিসার মহোদয়”।

No comments