মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বাংলাদেশের দারিদ্র্যঃ খাল কেটে কুমির না সমুদ্র কেটে হাঙ্গর
মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বাংলাদেশের দারিদ্র্যঃ খাল কেটে কুমির না সমুদ্র কেটে হাঙ্গর!!!!
আমাদের দেশের খুব জনপ্রিয় খেলা হচ্ছে ক্রিকেট। এই ক্রিকেট খেলার মাঠের খুব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে পিচ যেখানেই মূলত খেলাটা হয়। এখন যদি আপনি সিমেন্টের তৈরি পিচ বাদ দিয়ে এবড়ো থেবড়ো মাঠে খেলাটা শুরু করেন তবে বল একবার যাবে দশ হাত ডান দিয়ে তো পরের বার তা যাবে বিশ হাত উপর দিয়ে।
ঠিক সেরকম মুক্তবাজার অর্থনীতি । ক্রিকেট খেলার মতই এটিও খুব জনপ্রিয় কিন্তু তার আগে প্রয়োজন সঠিক পিচ অর্থাৎ সঠিক ও মসৃণ অর্থনৈতিক পরিবেশ যেখানে এই অর্থনীতির সঠিক চর্চা করা সম্ভব। অন্যথায় এটিও এবড়ো থেবড়ো মাঠের ক্রিকেট বলের মতই মাথার উপর দিয়ে অথবা দশ হাত দূর দিয়েই যাবে।
গফুর মিয়ার নিজ কারখানায় তৈরি ও তুলানামুলক অর্ধেক মূল্যের নিম সাবান আমরা কিনি না শুধুমাত্র লাক্স এর মত এই সাবানের বিজ্ঞাপনে ঐশ্বরিয়া নেই তাই? ফারুক মিয়ার হাতে তৈরি আলুর চিপস বাদ দিয়ে লেইস চিপস খাচ্ছি শুধু রঙ্গিন কাগজের লোভে? পাকিস্তানের তৈরি ফ্যান, ভারতের কাপড়, চাইনিজ মোবাইল সব বাইরের আর দেশপ্রেম দেখাই শুধু মুরগী আর গরুর বেলায়?
আগের দিনে দেশ দখল করা হত। কিন্তু এখন আর দেশ না দখল করা হয় সেই দেশের বাজার। কারন বাজার দখল করলেই সেই দেশের সমস্ত সম্পদ দখল করা সম্ভব।
বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো মুক্তবাজার অর্থনীতি। অর্থনীতিই সমাজের মূল ভিত্তি। কাজেই অর্থনীতির যেকোনো পরিবর্তন মানুষের সামাজিক অবস্থা ও চিন্তাভাবনার ওপর প্রভাব ফেলে। তাই এ ধরনের চিন্তাভাবনা আজ শুধু অর্থনীতির ভাবুক মহলেই সীমাবদ্ধ নেই এটি সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। অর্থনীতির মুক্তবাজারমুখী পরিবর্তন জীবনের সর্বস্তরে প্রভাব বিস্তার করছে। বিশ্বের দ্রুত পরিবর্তনশীল অর্থনীতিতে মুক্তবাজার অর্থনীতির যে প্রভাব পড়ছে তার শুভ -অশুভ পরিণাম সম্পর্কে আগ্রহশীল মানুষ নানা ভাবনার প্রকাশ ঘটাচ্ছে। তাই এর স্বরূপ সন্ধান করে তার কল্যাণ -অকল্যাণ সম্পর্কে বিবেচনা করা দরকার।
বাজার অর্থনীতি বলতে এমন এক অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াকে বুঝায় যা মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাজারের শক্তি তথা চাহিদা ও সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল। বাজারের এই স্বাভাবিক শক্তি তথা চাহিদা ও সরবরাহের ওপর নিয়ন্ত্রণহীনতাই মুক্ত বাজারের স্বরূপ।
মুক্ত মানে নিয়ন্ত্রণহীনতা। বাজার অর্থনীতিতেও স্বাভাবিক শক্তিগুলোর ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এটি এমন এক প্রকার অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া যা পণ্য বা সেবার দাম নির্ধারণের দায়িত্বটা বাজারের শক্তিসমূহ ও সরবরাহের হাতে ছাড়া হয়। অর্থাৎ, চাহিদা ও যোগানের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার দ্বারা পণ্যের মূল্য নির্ধারিত হয়।
মুক্তবাজার অর্থনীতি সম্পর্কে অর্থনৈতিক মহল ও সাধারণ জনমনে পরস্পর বিপরীতধর্মী ধারণার জন্ম নিয়েছে এটা অসাভাবিক নয়। কেননা বর্তমান অর্থনীতিতে এ মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারণা খুব বেশি দিনের নয়। তদুপরি বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের দুর্বল অর্থনীতির একটি দরিদ্র দেশ। অনেকেই মনে করেন মুক্তবাজার অর্থনীতি দেশের শিল্পকারকানা বা উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসের জন্য দায়ী। মুক্তবাজার মানেই অন্য দেশের শিল্পের স্বার্থরক্ষা এবং অন্য দেশের পণ্যের বাজার সৃষ্টি করা। মুক্তবাজার মানেই স্বদেশী পণ্য বর্জন এবং বিদেশি পণ্য গ্রহণ। মুক্তবাজার মানেই অনুন্নত দেশের শিশু শিল্পগুলোকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া এবং এরই ফলস্বরূপ বেকারত্ব বৃদ্ধি।
মুক্তবাজার অর্থনীতি বিশ্ব অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বা অবদান রাখলেও অনুন্নত দেশগুলোতে আপাতদৃষ্টিতে শিল্পায়নের পথে বাঁধার সৃষ্টি করে। অবাধ বাণিজ্যের সুযোগ নিয়ে শিল্পোন্নত দেশসমূহ অনুন্নত দেশের বাজার দখল করবে। বাংলাদেশে মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু হলে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প এবং শিল্পকারখানায় প্রভুত ক্ষতি সাধিত হবে বলে ধারণা করা হয়। কারণ মুক্তবাজার মানেই অনুন্নত দেশের শিশু শিল্পগুলোকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া। রুগ্ন শিল্পকেও চিরতরে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয় মুক্তবাজার। আর শিল্পখাতকে ধ্বংসের মুখোমুখি করা মানে দেশে বেকারত্ব বৃদ্ধি করা। তাই অনেকে মনে করেন মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু হয়ে বাংলাদেশের শিল্প ধ্বংসের দিকে এগোচ্ছে।
যেই সকল কম পুজিসম্পন্ন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা দাঁড়াতে চাচ্ছে তাদের চেষ্টা এবং শ্রম দিয়ে, কিন্তু মুক্তবাজারের রাঘব বোয়াল দের হাতে প্রতিনিয়ত মার খেয়ে হতাশ হয়ে পরছে তারা। না পারছে রাঘব বোয়াল দের সাথে টক্কর দিতে না পারছে ভোক্তাদের মন যোগাতে। এ যেন ১০০ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায় কেউ ৯০ মিটার পার করার আরেকজনের দৌড় শুরু করলে যে অবস্থা হয় আমাদের দেশের অবস্থা ঠিক তেমনই। উপরের উদাহরণের মতই এই ভয়াবহ বাস্তবতা আজ আমাদের। আমরা কষ্ট করছি, রোজগার করছি আর কষ্টের সব টাকা দিয়ে দিচ্ছি বাইরের দেশের শিল্পপতিদের এই মুক্তবাজারের নামে হালাল করে। অথচ নিজের পন্য অন্য দেশের বাজারে বিক্রি করতে পারছি না। ধনী শিল্পোন্নত দেশগুলো নিজে আরও ধনী হচ্ছে আর গরীব দেশগুলো হচ্ছে আরও গরীব।
মুক্তবাজার অর্থনীতির সর্বপ্রধান শর্ত হলো উৎপাদন, ব্যবস্থাপনা ও মান উন্নয়ন নিশ্চিত করা, তাহলেই আজকের প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকা সম্ভব। বাজার দখল করতে হলে উৎপাদন ব্যয় কমানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার পাশাপাশি গুণগত মানেও পণ্য প্রথম শ্রেণির হতে হবে। বাজার দখলে শ্রমশক্তিকেও কাজে লাগাতে হবে।
বিদেশী পন্য গুলো যাতে সহজ শুল্কে দেশের বাজারে প্রবেশ করতে না পারে সেদিক লক্ষ্য রাখতে হবে। নিজ দেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সরকারি ভাবে সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে। তাদেরকে দক্ষ করে তুলতে হবে। পন্যর গুনগত মানের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এবং ভোক্তাদেরও উচিত হবে নিজ দেশের পন্যকে ভালবেশে দেশের অর্থনীতির চাকা সামনের দিকে নিয়ে যাওয়া। কারন অর্থনৈতিক সচ্ছলতা পারে উন্নতির দিকে দেশকে তুলে নিয়ে যেতে। আর নিজ দেশের পন্য ব্যবহার করে যে শুধু অর্থনৈতিক উন্নতি হবে তাই নয় এটি দেশ প্রেম প্রকাশের একটি অন্যতম মাধ্যম।
কারণ, “স্বদেশী পণ্য, কিনে হও ধন্য”
লেখকঃ মাহ্দী যুবায়ের
প্রভাষক- ইউনাইটেড পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, জামালপুর
No comments